
গাজায় ত্রাণ সংগ্রহের কয়েক মিনিট বা সেকেন্ডের মধ্যে একটি ক্ষুধার্ত শিশুকে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার সাক্ষী এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেছেন সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার অ্যান্থনি অ্যাগুইলার, যিনি সম্প্রতি গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নিচে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং সত্যতা তুলে ধরা হলো:
ঘটনার বিবরণ
- সময় ও স্থান: ঘটনাটি গাজার একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে সংঘটিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশিত না হলেও, ২০২৫ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে এটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রটি গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ছিল, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পরিচালিত একটি বিতর্কিত সংস্থা।
- শিকার: নিহত শিশুটি একজন ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শিশু, যার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। শিশুটি ত্রাণ সংগ্রহের জন্য এসেছিল এবং ত্রাণ গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়।
- সাক্ষী ও অভিযোগকারী: অ্যান্থনি অ্যাগুইলার, একজন সাবেক মার্কিন সেনা বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা, এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করছিলেন এবং গত জুন মাসে সংস্থাটি থেকে পদত্যাগ করেন। অ্যাগুইলার দাবি করেছেন, শিশুটি ত্রাণ নেওয়ার “সেকেন্ড” বা “মিনিট” পরেই ইসরায়েলি সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি এই ঘটনাকে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
- প্রেক্ষাপট: গাজায় চলমান ইসরায়েলি সামরিক অভিযান এবং ত্রাণ বিতরণে কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে সেখানকার বাসিন্দারা মারাত্মক খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। মার্চ ২০২৫ থেকে ইসরায়েল ত্রাণ প্রবেশে কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে, যদিও মে মাস থেকে সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে, সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, এই ত্রাণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অ্যান্থনি অ্যাগুইলারের বক্তব্য
- অ্যাগুইলার জিএইচএফ-এর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, জিএইচএফ-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ইসরায়েলি সেনারা উপস্থিত ছিল এবং তারা সেখানে সশস্ত্র নজরদারি করছিল।
- তিনি ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, শিশুটি ত্রাণ নিয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত বলে তিনি মনে করেন।
- অ্যাগুইলার আরও বলেন, “আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন? ওয়াশিংটনের ইভাঞ্জেলিকাল জায়নিস্টদের, যাদের লাখো ডলারের স্বার্থ জড়িত, নাকি সেই ব্যক্তিকে, যিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন যখন শিশুটি নিহত হলো?”
- তিনি জিএইচএফ-এর প্রধান, যিনি একজন ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টান এবং ইসরায়েলের সমর্থক, তাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন। অ্যাগুইলারের দাবি, জিএইচএফ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, যা ত্রাণ বিতরণকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিক্রিয়া
- ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এই ঘটনার সুনির্দিষ্ট বিবরণ বা অবস্থান জানানো না হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
- তবে, অতীতে অনুরূপ ঘটনায় ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করে থাকে যে, তাদের হামলা হামাস বা অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়। এই ক্ষেত্রেও তারা একই ধরনের ব্যাখ্যা দিতে পারে, যদিও কোনো শিশুকে লক্ষ্য করে হামলার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনো প্রকাশিত হয়নি।
- ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ত্রাণ বিতরণের সময় ইসরায়েলি বাহিনী অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবা গাড়িতে গুলি চালায়, যা এই ঘটনার প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সত্যতা যাচাই
- অ্যাগুইলারের বিশ্বাসযোগ্যতা: অ্যান্থনি অ্যাগুইলার একজন প্রাক্তন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা এবং তিনি জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করেছেন, যা তার বক্তব্যকে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়। তবে, তিনি সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন এবং পদত্যাগ করেছেন, যা তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তার দাবির সমর্থনে কোনো ভিডিও বা সরাসরি প্রমাণ এখনো প্রকাশিত হয়নি।
- এক্স-এর পোস্ট: একাধিক এক্স পোস্টে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে অ্যাগুইলারের বক্তব্যের ভিত্তিতে শিশুটির হত্যার কথা বলা হয়েছে। তবে, এই পোস্টগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি এবং এগুলোকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।
- প্রেক্ষাপটের সত্যতা: গাজায় ত্রাণ বিতরণের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার একাধিক ঘটনা পূর্বে নথিভুক্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের অ্যাম্বুলেন্সে হামলায় ১৫ জন নিহত হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনা অ্যাগুইলারের দাবিকে সমর্থন করে।
- বিবিসি প্রতিবেদন: বিবিসির একটি প্রতিবেদনে গাজায় ত্রাণ সংগ্রহের সময় একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন, আবদুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি ত্রাণের ময়দার বস্তা আনতে গিয়ে ইসরায়েলি গুলিতে নিহত হন। এই প্রতিবেদন শিশুটির নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ না করলেও, ত্রাণ বিতরণের সময় হামলার প্রেক্ষাপট নিশ্চিত করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- এই ঘটনা গাজার মানবিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে। সাহায্য সংস্থাগুলো গাজায় “বড় আকারে দুর্ভিক্ষ” ছড়িয়ে পড়ার সতর্কতা দিয়েছে।
- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছে। তবে, এই নির্দিষ্ট ঘটনার তদন্তের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এখনো ঘোষিত হয়নি।
- এক্স-এর পোস্টগুলোতে এই ঘটনার প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটায়।
সত্যতার সীমাবদ্ধতা
- অ্যাগুইলারের বক্তব্য ছাড়া এই ঘটনার সরাসরি কোনো ভিডিও বা দলিল প্রকাশিত হয়নি, যা এর সত্যতা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে বাধা সৃষ্টি করে।
- ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না থাকায় ঘটনার তাদের ব্যাখ্যা জানা যায়নি।
- এক্স পোস্টগুলো জনমতের প্রতিফলন হলেও, এগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
উপসংহার
গাজায় ত্রাণ নেওয়ার পর একটি ক্ষুধার্ত শিশুর হত্যার ঘটনা অ্যান্থনি অ্যাগুইলারের বক্তব্যের মাধ্যমে সামনে এসেছে। ত্রাণ বিতরণের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার পূর্বের ঘটনা এবং গাজার চলমান মানবিক সংকট এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটকে সমর্থন করে। তবে, সরাসরি প্রমাণের অভাবে ঘটনার পূর্ণ সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। এই ঘটনা গাজার মানবিক সংকট এবং ত্রাণ বিতরণে নিরাপত্তার অভাবের বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।